পদ্মা নদীতে ইলিশ ধরায় সরকারি নিষেধাজ্ঞা চললেও মাদারীপুরের শিবচর উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় চলছে প্রকাশ্যে ইলিশ বিক্রির রমরমা ব্যবসা। বিশেষ করে বন্দরখোলা ইউনিয়নের কাজিরসূরা এলাকায় নদীপাড়ে বসছে অস্থায়ী হাট। এখানে কেউ ইলিশ কিনছেন জোড়া ধরে, কেউ কিনছেন ‘ঠিকা’ দরে। ক্রেতাদের কোলব্যাগভর্তি তাজা ইলিশ, আর জেলেদের মুখে অভাবের দীর্ঘশ্বাস—চলছে এক অঘোষিত লড়াই।
নদীপাড়ে জেলেদের হাট, ভিড় জমাচ্ছেন ক্রেতারা
গতকাল শুক্রবার বিকেলে কাজিরসূরা এলাকায় দেখা গেছে, মাঝনদী থেকে নৌকাভর্তি ইলিশ নিয়ে ভিড়ছেন জেলেরা। সঙ্গে সঙ্গে হাঁকডাক শুরু করেন ক্রেতারা—‘কেজি কত?’, ‘জোড়া কত?’ আবার কেউ জিজ্ঞেস করছেন, ‘থালার সবগুলো ঠিকায় কত?’ এই অস্থায়ী হাটে এক কেজির বেশি ওজনের ইলিশ বিক্রি হচ্ছে ১,৫০০ থেকে ১,৮০০ টাকায়। ছোট ইলিশ মিলছে ৩০০ থেকে ৫৫০ টাকায়।
শুধু কাজিরসূরা নয়, বন্দরখোলা, মাদবরেরচর, চরজানাজাত ও কাঁঠালবাড়ি ইউনিয়নের আরও চারটি নদীপাড়ে একইভাবে চলছে ইলিশ বেচাকেনা। জেলেরা নৌকা থেকেই বিক্রি করছেন ইলিশ, আর পাশে বসে পাইকাররা সাজিয়ে রাখছেন মাছ। সেই ডালি ঘিরে দরদাম করছেন সাধারণ মানুষ, পুরুষের পাশাপাশি নারীরাও।
নিষেধাজ্ঞার তোয়াক্কা নেই, প্রশাসনের নজরদারিও দুর্বল
সরকার ৪ থেকে ২৫ অক্টোবর পর্যন্ত ২২ দিন মা ইলিশ ধরায় নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। কিন্তু বাস্তবে তার খুব একটা প্রয়োগ দেখা যাচ্ছে না। স্থানীয়রা বলছেন, “অভিযান হলেও তা ঢিলেঢালা। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই জেলেরা পুলিশের চোখ ফাঁকি দিয়ে মাছ ধরেন ও বিক্রি করেন।”
জেলে আব্বাস মাদবর বলেন, “আমরা কার্ড পাই না, চালও পাই না। কেউ সাহায্য করে না। খাবো কী, তাই মাছ ধরতে আসি।” বিক্রেতা মো. মাসুদ বলেন, “পুলিশ এলে সবাই পালায়, পরে আবার এসে বসি।”
প্রশাসনের অভিযান, কিন্তু ঘাটে ঘাটে হাট
শিবচরের সিনিয়র মৎস্য কর্মকর্তা সত্যজিৎ মজুমদার বলেন, “গত সোমবার সেনাবাহিনী নিয়ে অভিযান করেছি। তবে আবারও হাট বসেছে। লোকবল কম, তাই সব জায়গায় অভিযান চালানো সম্ভব হয় না।”
ইউএনও এইচ এম ইবনে মিজান বলেন, “অস্থায়ী হাটগুলো দুর্গম এলাকায় হওয়ায় অভিযান চালানো কঠিন। ক্রেতাদের আটক ও জরিমানার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।”
জেলা মৎস্য কর্মকর্তা হাদিউজ্জামান বলেন, “ইলিশ রক্ষায় ২৪ ঘণ্টা নজরদারির দরকার, কিন্তু লোকবল সংকটে তা সম্ভব হচ্ছে না।”
জেলেরা বলছেন, “পেটের দায়ে নদীতে নামি”
অবৈধ শিকারে যুক্ত থাকার দায়ে ১৩ দিনে ৪৩ জন জেলেকে আটক করা হয়েছে। ধ্বংস করা হয়েছে ৭ লাখ ৪০ হাজার মিটার কারেন্ট জাল। তবু জেলেরা বলছেন, সরকারপ্রদত্ত সহায়তা না পেয়ে বাধ্য হয়েই নদীতে নামতে হচ্ছে।
সরকারি নিষেধাজ্ঞা, অভিযান ও জরিমানার মধ্যেও পদ্মার পাড়ে অবাধে চলছে ইলিশ শিকার ও বিক্রি। একদিকে জীবিকা রক্ষা, অন্যদিকে আইন অমান্য—এই দ্বন্দ্বের মাঝে হারিয়ে যাচ্ছে মা ইলিশ। প্রশ্ন উঠছে—শুধু জেলেই নয়, ক্রেতাদের প্রতিও কি আইনি নজরদারি জরুরি নয়?