ভারতে ‘আই লাভ মুহাম্মদ (সা.)’ বলায় মুসলিমদের ওপর দমন–পীড়ন

আন্তর্জাতিক ডেস্ক | আপডেট: ১৫ অক্টোবর ২০২৫

ভারতের বিজেপিশাসিত রাজ্যগুলোতে সম্প্রতি “আই লাভ মুহাম্মদ (সা.)” লেখা পোস্টার, টি-শার্ট, ব্যানার বা অনলাইনে পোস্ট শেয়ার করাকে কেন্দ্র করে মুসলিমদের বিরুদ্ধে ব্যাপক দমন–পীড়নের অভিযোগ উঠেছে। অলাভজনক সংগঠন এপিসিআর (APCR) জানিয়েছে, এখন পর্যন্ত ২২টি মামলা ও আড়াই হাজারের বেশি মুসলিমকে আসামি করা হয়েছে। এর মধ্যে অন্তত ৪০ জন গ্রেপ্তার হয়েছেন।

কী থেকে ঘটনার সূত্রপাত?

সবকিছু শুরু হয় উত্তর প্রদেশের কানপুরে ঈদে মিলাদুন্নবী উদ্‌যাপন উপলক্ষে। ৪ সেপ্টেম্বর মুসলিমরা একটি বোর্ড টাঙান, যাতে লেখা ছিল—“I Love Muhammad (সা.)”। স্থানীয় কিছু হিন্দু নেতা অভিযোগ করেন, এটি আইনশৃঙ্খলার জন্য হুমকি এবং “ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত”। পুলিশ এরপর ধর্মীয় উত্তেজনা ছড়ানোর অভিযোগে কয়েক ডজন মুসলিমের বিরুদ্ধে মামলা করে। এর জেরে রাজ্যজুড়ে এবং পরে দেশজুড়ে মুসলিমদের বিরুদ্ধে অভিযান শুরু হয়। কোথাও বিনা নোটিশে বাড়ি ভেঙে ফেলা হচ্ছে, কোথাও টি-শার্ট পরার অপরাধে গ্রেপ্তার, আবার কোথাও সামাজিক মাধ্যমে পোস্ট শেয়ারের কারণে মামলা হচ্ছে। ঘটনা ছড়িয়ে পড়ে দেশজুড়ে। বেরেলি, গুজরাট, তেলেঙ্গানা, মহারাষ্ট্র ও কাশ্মীর—এসব রাজ্যে বিক্ষোভ হয়েছে।বেরেলিতে বিক্ষোভের পর ৭৫ জন গ্রেপ্তার, স্থানীয় ইমাম তৌকির রেজাসহ আরও অনেকে আটক। বহু স্থানে বুলডোজার চালিয়ে বাড়িঘর ভাঙা হচ্ছে—যার বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তুলছে মানবাধিকার সংস্থাগুলো।

আইনত কী বলছে?

ভারতের সংবিধানের ২৫ ধারা ধর্ম পালনের স্বাধীনতা নিশ্চিত করে।
১৯(১)(ক) ধারায় বাকস্বাধীনতা ও মতপ্রকাশের অধিকার দেওয়া হয়েছে, যতক্ষণ না তা সরাসরি সহিংসতা উসকে দেয়।

আইনগতভাবে “আই লাভ মুহাম্মদ (সা.)” বলা কোনো অপরাধ নয়।
কিন্তু পুলিশ সাধারণত “ধর্মীয় বিদ্বেষ ছড়ানো”, “আইনশৃঙ্খলা ভঙ্গ”, বা “উসকানি” ধারা প্রয়োগ করে অভিযুক্তদের গ্রেপ্তার করছে।

বিশ্লেষণ ও সমালোচনা

মানবাধিকার সংস্থা ও রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা এই ঘটনাকে “রাষ্ট্রীয় পক্ষপাতিত্ব ও সংখ্যালঘুবিরোধী মনোভাবের প্রকাশ” বলে আখ্যা দিচ্ছেন।

নাদিম খান, এপিসিআর-এর জাতীয় সমন্বয়ক বলেন: “সরকার জানে এই বাক্য বেআইনি নয়। তাই সরাসরি বাক্যটিকে টার্গেট না করে, যারা এটি লিখেছে বা বলেছে, তাদের বিরুদ্ধে ভিন্ন ধারায় মামলা করা হচ্ছে।”

আসিম আলি, রাজনৈতিক বিশ্লেষক বলেন: “এখন মুসলিমদের যেকোনো ধর্মীয় পরিচয়ের বহিঃপ্রকাশই উসকানিমূলক বলে ধরা হচ্ছে।”

অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল ইন্ডিয়ার চেয়ারম্যান আকার প্যাটেল বলেন: “আই লাভ মুহাম্মদ (সা.) বলা অপরাধ হতে পারে না। এটা শান্তিপূর্ণ মতপ্রকাশ, যা ভারতের সংবিধান ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনে সুরক্ষিত।”

মোদির শাসনামলে ধর্মীয় নিপীড়নের চিত্র

২০১৪ সালে মোদি ক্ষমতায় আসার পর মুসলিমদের ওপর সহিংসতা ও বৈষম্যের ঘটনা ক্রমাগত বেড়েছে:

২০২৩ সালে ধর্মীয় বিদ্বেষমূলক মন্তব্যের ঘটনা ছিল ৬৬৮টি,

২০২৪ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ১,১৬৫টিতে—অর্থাৎ প্রায় ৭৪% বৃদ্ধি,

এসব ঘটনার বেশির ভাগ ঘটেছে বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলোতে।

বারানসীতে বিতর্কিত প্রতীক

কানপুরের ঘটনার পর মোদির নিজ এলাকা বারানসীতে বিজেপি সমর্থকেরা “I Love Bulldozer” লেখা ব্যানার টাঙিয়েছেন—যা পরিষ্কারভাবে সংখ্যালঘু দমননীতি ও উসকানির প্রতীক হয়ে উঠেছে।

‘আই লাভ মুহাম্মদ (সা.)’ বলার কারণে হাজারো মুসলিমের বিরুদ্ধে যেভাবে পুলিশি ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে, তা শুধুই মতপ্রকাশের স্বাধীনতার ওপর নয়, বরং একটি ধর্মের অস্তিত্ব ও পরিচয়ের ওপরও আঘাত। ভারতের সংবিধান যেটাকে অধিকার হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে, সেই অধিকার আজ ‘আইনশৃঙ্খলা হুমকি’র অজুহাতে দমন করা হচ্ছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, এটি কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, বরং দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক ও ধর্মীয় বৈষম্যেরই ধারাবাহিক রূপ।

Check Also

ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে সম্ভাব্য একাদশে পরিবর্তনের আভাস, দলে ফিরছেন জাকের-সৌম্য

সংবাদ প্রতিবেদন:দীর্ঘদিন ধরে ওয়ানডে ফরম্যাটে হতাশাজনক পারফরম্যান্সে ভুগছে বাংলাদেশ ক্রিকেট দল। আফগানিস্তান সিরিজ থেকে শুরু …

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।