আন্তর্জাতিক ডেস্ক
১২ অক্টোবর ২০২৫
টানা দুই বছরের ইসরায়েলি হামলায় ধ্বংসস্তূপে পরিণত গাজা উপত্যকা। কেবল বসতবাড়ি নয়, নিশ্চিহ্ন হয়েছে শতাব্দীপ্রাচীন মসজিদ, মিনার ও ইসলামী স্থাপত্য। তবুও ধ্বংসের স্তূপের মধ্যেই আজান দিচ্ছেন মুয়াজ্জিনরা, নামাজে ঝুঁকছেন ফিলিস্তিনিরা।
‘দ্য ফিলিস্তিন ইনফরমেশন সেন্টার’-এর এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গাজার আকাশে আজ আর মিনার নেই, নেই গম্বুজ। তবু ধুলা-পাথরের স্তূপ থেকে ভেসে আসছে আজানের কণ্ঠ—যেন ধ্বংস নয়, বরং বিশ্বাসই এখানকার প্রকৃত অবশিষ্ট।
শতাব্দীর ইতিহাস গুঁড়িয়ে গেছে
ইসরায়েলের লাগাতার আগ্রাসনে গাজার ঐতিহাসিক মসজিদগুলো প্রায় নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। গাজার সরকারি মিডিয়া অফিস জানিয়েছে, ১,২৪৪টি মসজিদের মধ্যে ৮৩৫টি পুরোপুরি ধ্বংস এবং ১৮০টি আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এর মধ্যে মামলুক ও অটোমান শাসনামলের বহু স্থাপত্যও রয়েছে, যা মুসলিম ইতিহাসের অমূল্য অংশ ছিল।
“আমি বাবার কণ্ঠের আগে মুয়াজ্জিনের কণ্ঠ চিনেছি”
গাজার শুজাইয়্যা এলাকার ৬২ বছর বয়সী আবু খালেদ আল-নাজ্জার বলেন,
“আমার বাবার কণ্ঠস্বর চেনার আগেই আমি মুয়াজ্জিনের কণ্ঠ চিনতাম। পঞ্চাশ বছর ধরে এখানে নামাজ পড়েছি। আজ মসজিদের দরজার পাশের নামাজের গালিচাটাও ধ্বংসস্তূপের নিচে হারিয়ে গেছে।”
তার কণ্ঠে বেদনা, কিন্তু তাতে হারের সুর নেই।
“তারা ভবন নয়, স্মৃতিও মুছে ফেলতে চায়”
পুরনো শহরের গ্রেট ওমারি মসজিদ, যা গাজার প্রাণ হিসেবে বিবেচিত হতো, তা এখন ধুলায় পরিণত। সেখানেই ২৭ বছর বয়সী মাহমুদ কান্দিল খুঁজছিলেন কিবলার দেয়ালের পাথর। তিনি বলেন,
“এই মসজিদ ছিল গাজার আত্মা। এখন মনে হচ্ছে শুধু স্থাপনা নয়, আমাদের স্মৃতিগুলোও নিশ্চিহ্ন করে দিতে চায় ইসরায়েল।”
“আল্লাহ আমাদের কথা শুনবেন, যেখানেই থাকি”
আল-দারাজপাড়ার আল-সাইয়্যিদ হাশিম মসজিদ ছিল গাজার এক গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় স্থান। ৭৪ বছর বয়সী উম্মে ওয়ায়েল ধ্বংসাবশেষের সামনে বসে বলেন,
“আমি অসুস্থ থাকলেও প্রতি বৃহস্পতিবার এখানে সূরা আল-কাহফ পড়তাম। এখন যাওয়ার জায়গা নেই। তবু ঘরে বসে কুরআন পড়ব। আল্লাহ আমাদের কথা শুনবেন—যেখানেই থাকি।”
ধর্মীয় নিদর্শন ধ্বংস: কেবল যুদ্ধ নয়, সাংস্কৃতিক নিধন
বিশেষজ্ঞদের মতে, মসজিদ, কবরস্থান এবং অন্যান্য ধর্মীয় নিদর্শনকে নিশানা করে হামলা চালানো কোনো কৌশলগত ভুল নয়, বরং পরিকল্পিত সাংস্কৃতিক নিধনের অংশ। ঐতিহাসিক মসজিদগুলো ধ্বংসের অর্থ হলো—একটি জাতির বিশ্বাস, ইতিহাস ও পরিচয় মুছে ফেলা।
ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়েছে শুধু পাথর নয়, চাপা পড়েছে ইতিহাস, বিশ্বাস, সংস্কৃতি। কিন্তু গাজার মানুষ জানিয়ে দিচ্ছে—ভবন ভাঙলেও আত্মা ভাঙে না। আজান বন্ধ হয় না। ধ্বংসস্তূপের ভেতর থেকেও ইমানের সুর ভেসে আসে, উঠে আসে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর প্রতিজ্ঞা।