📅 প্রকাশ: ৮ অক্টোবর ২০২৫ |
বাংলাদেশের দ্রুতবর্ধনশীল নগর ব্যবস্থাপনায় বারবার ব্যর্থতার চিত্র উঠে আসছে নানা পর্যায়ের বিশ্লেষণে। এবার এ সমস্যার মূল কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে বহুমুখী কর্তৃত্ব, সমন্বয়হীন প্রশাসন ও মন্ত্রণালয়নির্ভরতা। নগর সেবাকে আধুনিক ও কার্যকর করতে সিটি করপোরেশনের পরিবর্তে প্রকৃত “সিটি গভর্নমেন্ট” প্রতিষ্ঠার আহ্বান জানিয়েছেন নগর পরিকল্পনা ও প্রশাসন বিশ্লেষক দেলোয়ার মজুমদার।
তিনি বলেন, “বর্তমান সিটি করপোরেশন কাঠামো আইনত স্বায়ত্তশাসিত হলেও বাস্তবে একাধিক মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ নানা সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানের কারণে তা কার্যত অকার্যকর। নগরবাসীর ভোগান্তি পিছু হটছে না।”
নাগরিক সেবায় দুর্ভোগ চরমেঃ
ঢাকা ও চট্টগ্রাম দুই সিটি করপোরেশনের নাগরিক সেবা নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে অসন্তোষ বিরাজ করছে। ঢাকায় অন্তত ২৪টি সংস্থা নাগরিক সেবায় জড়িত থাকলেও তাদের মধ্যে নেই কোনো কার্যকর সমন্বয়। এর ফলে বারবার রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি, জলাবদ্ধতা, বর্জ্য সমস্যা, যানজট ও দূষণ বেড়েই চলেছে। একই চিত্র চট্টগ্রামেও, যেখানে বন্দর সংলগ্ন এলাকাগুলোতে অতিরিক্ত যানবাহন ও শিল্প-দূষণ চরম আকার ধারণ করেছে।
আইন আছে, কিন্তু কার্যকর নয়ঃ
২০০৯ সালের সিটি করপোরেশন আইন অনুযায়ী, সিটি করপোরেশন একটি স্বশাসিত স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান। সংবিধানের ৫৯ ও ৬০ অনুচ্ছেদও স্থানীয় সরকারের প্রশাসনিক ও আর্থিক ক্ষমতা নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে দেওয়ার কথা বলেছে। কিন্তু বাস্তবে কর আরোপ, বাজেট অনুমোদন বা সেবার ধরন নির্ধারণে প্রতিবারই মন্ত্রণালয়ের অনুমতির অপেক্ষায় থাকতে হয়।
উদাহরণস্বরূপ, সিটি করপোরেশন আইন ২০০৯-এর ধারা ১০০ (২) অনুসারে কর আরোপে ক্ষমতা দেওয়া হলেও, তা বাস্তবায়নে সরকার প্রণীত বিধির উপর নির্ভরশীলতা রাখা হয়েছে।
মেয়রদের সীমিত ক্ষমতা ও বাধাগ্রস্ত উদ্যোগঃ
চট্টগ্রামের একটি উদাহরণে দেখা গেছে, বর্ষার আগে মেয়র বিভিন্ন সংস্থাকে নির্দিষ্ট সময়ে সড়ক খোঁড়ার অনুরোধ করেন। কিন্তু কেউ প্রকল্প অনুমোদন পায়নি, কেউ টেন্ডার করতে পারেনি—ফলে মেয়রের নির্দেশ কার্যকর হয়নি। এতে করে সমন্বয়হীনতা আরও প্রকট হয়। পরবর্তীতে যখন সড়ক মেরামত হয়ে যায়, তখন সংস্থাগুলো আবার কাটার অনুমতি চায়। মেয়র বলেন, “আমি না দিলে জনগণ যদি পানি না পায়, তার দায়ও আমাদের ওপরই পড়ে।”
প্রয়োজন কার্যকর সিটি গভর্নমেন্টঃ
বিশ্লেষকের মতে, বর্তমান কাঠামোর পরিবর্তে নির্বাচিত মেয়রের অধীন একটি একীভূত সিটি গভর্নমেন্ট গঠন করতে হবে, যেখানে সব সেবাদানকারী সংস্থা থাকবে এক ছাতার নিচে। বিশ্বের উন্নত শহরগুলোর (লন্ডন, নিউইয়র্ক, টোকিও, প্যারিস ইত্যাদি) মতো একটি কেন্দ্রীয় নগর সরকার হলে,
সময় ও অর্থ অপচয় কমবে,
উন্নয়ন কার্যক্রমে সমন্বয় আসবে,
জবাবদিহি নিশ্চিত হবে,
নাগরিক সেবার মান বৃদ্ধি পাবে,
ডিজিটাল সেবা ও স্মার্ট ট্রাফিক বাস্তবায়ন সহজ হবে।
করণীয়ঃ
এই রূপান্তরের জন্য জরুরি কিছু পদক্ষেপের সুপারিশ করা হয়েছে:
সিটি করপোরেশন আইন ২০০৯ সংশোধন করে মেয়রের হাতে নির্বাহী ক্ষমতা দেওয়া,
বাজেট ও কর নির্ধারণে মন্ত্রণালয় অনুমতি বাতিল,
সেবাদাতা সংস্থাগুলোকে সিটি গভর্নমেন্টের অধীনে আনা,
নাগরিকদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করে জবাবদিহিমূলক প্রশাসন গঠন।
সারাদেশেই প্রয়োগযোগ্য
এই মডেল শুধু ঢাকা বা চট্টগ্রামের জন্য নয়, বরং রাজশাহী, খুলনা, সিলেট, বরিশাল, রংপুর, নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর, কুমিল্লা—সব মহানগরের জন্য প্রয়োগযোগ্য।
বিশ্লেষকের মতে, এখনই কার্যকর সিটি গভর্নমেন্ট চালু না করলে নগরের বাসযোগ্যতা কমবে, বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ নষ্ট হবে এবং নাগরিক অধিকার ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
📌 উৎস: দেলোয়ার মজুমদার, সাবেক চেয়ারম্যান, ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন, বাংলাদেশ (আইইবি), চট্টগ্রাম কেন্দ্র।