নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকা
প্রকাশ: ১৫ অক্টোবর ২০২৫, ১৩:১৩
জুলাই জাতীয় সনদের চূড়ান্ত অনুলিপি দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে পাঠিয়েছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। আগামী শুক্রবার বিকেলে জাতীয় সংসদের দক্ষিণ প্লাজায় এই সনদে স্বাক্ষরের মধ্য দিয়ে এটি হবে দেশের ‘নতুন রাজনৈতিক সমঝোতার দলিল’— এমনটাই প্রত্যাশা করছে কমিশন।
গতকাল মঙ্গলবার রাতে রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে সনদের অনুলিপি পাঠানো হয়। ১১ সেপ্টেম্বর যেই খসড়া দলগুলোকে দেওয়া হয়েছিল, সেটিই কিছু শব্দগত সংশোধনের মাধ্যমে চূড়ান্ত করা হয়েছে। মূল বিষয়বস্তু অপরিবর্তিত রাখা হয়েছে।
সনদে তিনটি ভাগ
জুলাই জাতীয় সনদ তিনটি ভাগে বিভক্ত।
১. প্রথম ভাগে রয়েছে সনদের পটভূমি।
২. দ্বিতীয় ভাগে ৮৪টি সংস্কার প্রস্তাব।
৩. তৃতীয় ভাগে রয়েছে ৭ দফা বাস্তবায়ন অঙ্গীকারনামা।
জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ প্রথম আলোকে বলেন,
“সব দলের কাছে জুলাই জাতীয় সনদ পাঠানো হয়েছে। আগামী শুক্রবার ঐতিহাসিক মুহূর্তে সবার উপস্থিতিতে অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে সনদ স্বাক্ষর অনুষ্ঠান হবে। আমরা আশা করছি, সবার অংশগ্রহণের মাধ্যমে পরবর্তী ধাপে উপনীত হতে পারব।”
বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া এখনো চূড়ান্ত নয়
সনদটি স্বাক্ষরের পরই তা পূর্ণ বাস্তবায়নের অঙ্গীকার করবে দলগুলো। তবে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন এখনো সনদ বাস্তবায়নের নির্দিষ্ট পদ্ধতি বা সুপারিশ দেয়নি। স্বাক্ষর পরবর্তী সময়ে কমিশন সরকারের কাছে বাস্তবায়ন পরিকল্পনা তুলে ধরবে বলে জানা গেছে।
ঐকমত্য ও ভিন্নমতের চিত্র
ফেব্রুয়ারি থেকে জুলাই পর্যন্ত দুই ধাপে ৮৪টি সংস্কার প্রস্তাব নিয়ে ৬৩টি দলের সঙ্গে আলোচনা হয়েছে।
- ৩৩টি দল অংশ নেয় প্রথম পর্বে,
- ৩০টি দল অংশ নেয় দ্বিতীয় পর্বে।
সনদে বেশ কিছু বিষয়ে ভিন্নমত রয়েছে। যেমন:
- রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা,
- উচ্চকক্ষের ভূমিকা,
- নারী আসনের বিধান,
- তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা,
- দুর্নীতি দমন কমিশনের নিয়োগ ইত্যাদি।
এই ভিন্নমতগুলো “নোট অব ডিসেন্ট” হিসেবে সনদের সাথেই সংযুক্ত থাকবে।
সাত দফা অঙ্গীকার
সনদে রাজনৈতিক দলগুলো যেসব বিষয়ে অঙ্গীকার করছে, সেগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো:
১. জুলাই সনদকে নতুন রাজনৈতিক সমঝোতার দলিল হিসেবে পূর্ণ বাস্তবায়ন।
২. সংবিধানে সনদ যুক্ত করা।
৩. সনদের বৈধতা নিয়ে কোনো দল আদালতে প্রশ্ন তুলবে না।
৪. গণ-অভ্যুত্থানের ঐতিহাসিক স্বীকৃতি।
৫. গুম-খুনের বিচার ও ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারদের সহায়তা।
৬. আইনি ও সাংবিধানিক সংশোধন।
৭. অবিলম্বে বাস্তবায়নযোগ্য সিদ্ধান্তগুলো দ্রুত কার্যকর।
সনদে কী কী প্রস্তাব আছে?
চূড়ান্ত সনদে রয়েছে—
- প্রধানমন্ত্রী হিসেবে সর্বোচ্চ ১০ বছর দায়িত্ব পালনের সীমা।
- একজন ব্যক্তি একই সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী ও দলীয় প্রধান হতে পারবেন না।
- সংসদের উচ্চকক্ষ গঠন।
- বিরোধীদলের অংশগ্রহণে সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোর নিয়োগ কমিটি।
- বিচার বিভাগের বিকেন্দ্রীকরণ।
- নির্বাচন কমিশন, পুলিশ কমিশন, দুর্নীতি দমন কমিশনের গঠনপদ্ধতিতে পরিবর্তন।
- সুপ্রিম কোর্ট সচিবালয় ও অ্যাটর্নি সার্ভিস প্রতিষ্ঠা।
- তথ্য অধিকার আইন, আয়কর আইন, দুর্নীতি দমন কমিশন আইনের সংশোধন।
পরিবর্তিত হয়েছে কিছু ভাষা
চূড়ান্ত সনদে কিছু শব্দ বা বাক্য রদবদল করা হয়েছে।
যেমন—
খসড়ায় বলা হয়েছিল:
“শাসকগোষ্ঠীর প্রতিহিংসার শিকার হয়ে শিশু, নারীসহ প্রায় ১ হাজার নাগরিক নিহত হন…”
চূড়ান্ত সনদে বলা হয়েছে:
“শাসকগোষ্ঠীর প্রতিহিংসার শিকার হয়ে শিশু-নারীসহ সহস্রাধিক নিরস্ত্র নাগরিক নিহত হন… ‘ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা’ ও তাঁর দোসররা পরাজিত হয়ে অনেকেই পালিয়ে যেতে বাধ্য হন।”
এছাড়া খসড়ায় সংবিধানের ১০৬ অনুচ্ছেদে সুপ্রিম কোর্টের মতামতের ভিত্তিতে অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব নেওয়ার কথা বলা হয়েছিল। এখন সেটি সংশোধন করে বলা হয়েছে:
“গণ-অভ্যুত্থানের পর অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে ৮ আগস্ট অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণ করে।”
সনদে স্বাক্ষর করবে কে কে?
৩০টি রাজনৈতিক দল ইতিমধ্যে দুজন করে স্বাক্ষরকারীর নাম পাঠিয়েছে।
- প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস,
- জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সদস্য ও সহসভাপতিরা,
- প্রতিটি দলের প্রতিনিধিরা
এই ঐতিহাসিক সনদে স্বাক্ষর করবেন।
বিশেষ দ্রষ্টব্য:
সব দলের সই নিশ্চিত না হলেও, সনদ স্বাক্ষর অনুষ্ঠানকে ঘিরে ব্যাপক রাজনৈতিক গুরুত্ব তৈরি হয়েছে। আগামী শুক্রবারের অনুষ্ঠান দেশের নতুন রাজনৈতিক কাঠামোর দিকে একটি বড় পদক্ষেপ হতে পারে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকেরা।